ফিলিপ ওয়াল্টার ফোডেন
মানুষের জীবনে কত স্বপ্ন থাকে। মানুষ সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে কত কিছুই না করে। স্বপ্নের কাছে মানুষের সব কিছুই যেনো তুচ্ছ। যে মানুষটা স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বড় হয় তার কাছে তাবৎ দুনিয়াও যেনো নিছকই তুচ্ছ মনে হয়। কারণ স্বপ্নটা পূরণ করতে হবে যে! স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সে মানুষটা নিজেকে ছোট ভাবতেও দ্বিধাবোধ করে না। কারণ সে জানে এই ছোট এক সময় তাকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে। বলছিলাম ফিল ফোডেনের কথা।
পুরো নাম ফিলিপ ওয়াল্টার ফোডেন। এইতো ক’দিন আগেই ২০০০ সালে ২৮ এ মে তার জন্ম হয় ম্যানচেস্টারের স্টকপোর্ট নামক শহরে। একদমই মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ফোডেন জানতেন না একদিন তিনি কত বড় মঞ্চে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। মা ক্লেয়ার ফোডেন ও বাবা ফিল ফোডেন স্নারে কেউই ধনীক শ্রেনী থেকে উঠে আসেননি। ছোটবেলা থেকেই ম্যানচেস্টার সিটির ফ্যান ছিলেন ফিল। তাইতো মাত্র চার বছর বয়সে সিটির একাডেমীতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে একাডেমীর কোচিং ও সাইডলাইনে বল বয়ের কাজ। পড়াশুনার খরচ বহন করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। স্বপ্ন দেখতেন একদিন এই সিটির হয়ে স্টার বনে যাবেন। নিজেকে নিয়ে যাবেন এক অনন্য উচ্চতায়। চোখের সামনেই আগুয়েরো, সিলভাদের মত লিজেন্ডদের সাফল্য দেখে কে না চাইবে নিজেকে এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে?
২০১৪ সালে সোয়ানসিয়া সিটির সাথে ম্যান সিটির খেলা চলছিলো। এ ম্যাচে স্টেফান জোভেটিচ এর গোল স্কোরিং সেলিব্রেশনের ফ্রেমে ফোডেনকে সাইডলাইনে বসে থাকতে দেখা যায়। এ ছবিটি কারও না দেখার কথা না। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৪। তখনও সে বল বয়ের কাজ করে যাচ্ছে। একই সাথে একাডেমীতে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতেও সমস্যা হয়নি। ২০১৬ সালে প্রথম সিটির হয়ে নিজের কন্ট্রাক্ট সাইন করে এই ছোট্ট ফোডেন। ইতিমধ্যে তার কোচ হয়ে এসেছেন পেপ গার্দিওলা। ফোডেনের ক্যালিবার দেখে দেরী করেননি পেপ। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ইংল্যান্ডকে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ এনে দেন এই ফোডেন। ফাইনালে দুটি গোলও রয়েছে তার। সে বছর জিতে নেন 'গোল্ডেন বল এওয়ার্ড'। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। চ্যাম্পিয়নস লীগে করেছেন ১১ ম্যাচে তিন গোল তিন এসিস্ট।
সিটির হয়ে ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ফেইনুর্দের বিপক্ষে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই অভিষেক ঘটে ফিল ফোডেনের। ৭৫ মিনিটে ইয়া ইয়া তোরের বদলি হিসেবে নামেন যার ফলে চ্যাম্পিয়নস লীগের চতুর্থ সর্বকনিষ্ঠ ইংলিশ প্লেয়ার হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লিখান। এরপর সে বছরই শাখতার ডোনেস্কের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগের একাদশে স্টার্টার হিসেবে নেমে যান এবং চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ ইংলিশ প্লেয়ার হিসেবে ম্যাচ স্টার্টার হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লিখান। ২০০০ বা তার পরে জন্ম নেয়া ফুটবলারদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের কোন ম্যাচের স্টার্টার তো এই ফিল ফোডেনই! তাঁর কিছুদিন পরেই ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৭ তে টটেনহ্যাম হটস্পারের বিপক্ষে ৮৩তম মিনিটে সাবস্টিটিউট হিসেবে নেমে তাঁর প্রিমিয়ার লীগে ডেব্যু হয়। সেবারই ম্যানসিটি তাদের ইতিহাসের তৃতীয় প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা ঘরে তোলে এবং ফোডেন বনে যান সর্বকনিষ্ঠ প্লেয়ার হিসেবে প্রিমিয়ার লীগ উইনার। নাম লিখান গিনেস রেকর্ডবুকে! ইতিমধ্যে পেপ গার্দিওলা তো বটেই পুরো বিশ্বকে নিজের জাত চেনাতে ভুল করেননি এই ফিল। ১৮’ এর ডিসেম্বরেই বিবিসির ইয়াং পার্সোনালিটি অফ দ্য ইয়ার জিতেছিলেন ফোডেন।
ইতিমধ্যে তিনি স্টার্টার তো বটেই করে ফেলেছেন অনেক গোল। তবে শুরুর গোলটি আসে ইএফএল
কাপে, অক্সফোর্ড
ইউনাইটেডের বিপক্ষে।
ইঞ্জুরি টাইমে তার করা গোলটির মাধ্যমে ম্যানসিটি ৩-০ গোলে জিতে যায় ম্যাচটি! এখন পর্যন্ত তার
মোট গোলের সংখ্যা ২৯ এবং এসিস্ট ২২টি!
সবে মাত্র শুরু। পাড়ি দিতে হবে বহুদূর। ইতিমধ্যে ম্যান সিটির হয়ে পেপ গার্দিওলার আস্থা কুড়িয়ে নিয়েছেন ফিল ফোডেন। পেপ তো একবার বলেই ফেলেছিলেন যে, মেসির পর তার কোচিং ক্যারিয়ারের দেখা সবচেয়ে ট্যালেন্টেড ইয়ংস্টার এই ফোডেন। তবে কি স্বপ্ন পূরণ করে ফেলেছেন ফিল ফোডেন? আমি নিশ্চিত তাকে এই প্রশ্ন করা হলে বলবে এখনো সবে শুরু! আসলেই তো!
নিজের ক্যারিয়ার একজন মিডফিল্ডার হিসেবে শুরু করলেও বোধ করি না এখন কোনো পজিশনে তার খেলা বাকি আছে! যাই হোক, এবার সালটা ২০২১। একুশে একুশ বছরে পদার্পণ করা এই ফিল ফোডেন ইতিমধ্যে প্রিমিয়ার লীগ ছুঁই ছুঁই। হয়তো আরেকটা ম্যাচডে গেলেই অফিসিয়ালি ম্যান সিটি এবারের প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়ন। তবে এখানেই কি শেষ? ওইযে বলেছিলাম না, মানুষ স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠলে তাবৎ দুনিয়াই মনে হয় তুচ্ছ। এখনো যে অনেক কিছুই জয় করা বাকি এই ফিল ফোডেনের!
১৭' থেকে ১৯', টানা তিনবার সিটি চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়ার্টার ফাইনালে এসে হেরে যাচ্ছে। এবার ২০'-২১' সিজনে সিটি ইতিমধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছে। করোনা মহামারীতে মাঠে দর্শক না থাকাটা যেকোনো দলের জন্যই একটা মাইনাস পয়েন্ট। এরপরও ইয়ংস্টারদের রক্ত তো গরম! এরা কখনো থেমে থাকে না। কোয়ার্টার ফাইনালে ডর্ট্মুন্ডের সাথে শেষদিকে যখন ডি বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শটে গোল করে ফোডেন তখন অনেকেই ওকে চিনতে বাধ্য হয়। তখন হালান্ড, এম্বাপ্পে কিংবা ফাতিদের নামের পাশে একেও ভাবতে শুরু করেন অনেকে। গোলের পর দৌড়ে এসে গার্দিওলাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য কি কারো চোখ থেকে এড়িয়ে গিয়েছে? না! ফিল এর সাথে গার্দিওলার সেই মূহুর্তের একটা ছবি হুবুহু মেসি-গার্দিওলার সাথে মিলে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় হিড়িক পরে! তবে সেমি ফাইনালে পিএসজিকে হারানোর পর অনেকেই ফিল ফোডেনকে নতুন করে চিনতে বাধ্য হয়। এক হেংলা পাতলা ছেলে হঠাৎ করে বারবার পিএসজির ডিফেন্স ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে! শেষ মূহুর্তে রিয়াদ মাহরেজকে এসিস্ট করে বনে যান পুরো ফুটবল বিশ্বের চোখের মণি। কি স্পিড, কি পাস, কি ফিনিশিং!
২০২০-২১ সিজনের ফাইনালে হয়তো জিতে যাবে ছেলেটা হয়তোবা হেরে রানার আপ হয়েই ক্ষান্ত থাকতে হবে এবার। কিন্তু স্থানীয় সমর্থকদের দেওয়া “স্টকপোর্ট ইনিয়েস্তা” নামের প্রতি সুবিচার কতটুক করতে পারবেন ফোডেন এটা সময়ই বলে দিবে। তবে, আমার চাওয়া থাকবে ইনিয়েস্তা কিংবা মেসি নয়, ফিল ফোডেন ফিল ফোডেন হিসেবেই নিজের নাম অর্জন করবে। সবে তো শুরু! ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ এনে দিয়ে সিটির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ এখনো জিততে হবে যে!
Comments
Post a Comment