পুরান ঢাকার ‘ক্বাসিদা’

দূর থেকে গানের আওয়াজ বা কোনো সুরের আওয়াজ ভেসে আসলে কার না ভালো লাগে? মনে করুন, আপনি ঘুমিয়ে আছেন, আর হালকা হালকা শুনতে পাচ্ছেন কেউ সুর মিলিয়ে কিছু একটা গেয়ে যাচ্ছে বা কোথা থেকে যেনো একটা সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসছে কেমন লাগবে আপনার? নিশ্চই ভালো লাগার কথা। তার উপর সেটা যদি হয় পবিত্র রমজানের সেহরীর সময় তাহলে তো কোনো কথাই নেই! ক্বাসিদা এমনই একটি ঐতিহ্য পুরান ঢাকাবাসী পালন করে আসছিলো যেটি আজ বিলুপ্তপ্রায়।


ক্বাসিদা শব্দটি আরবী শব্দ হলেও এর বাংলা অর্থ হচ্ছে কবিতা বা প্রশংসামূলক গীত পুরান ঢাকার এক সময়ের ঐতিহ্য ছিলো এই ক্বাসিদা। বর্তমানে এর চল নেই বললেই চলে। মূলত পবিত্র রমজান মাস এলেই সেহরীর সময় মানুষের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে হেঁটে হেঁটে কোরাস গাওয়া হত। ৮-১০ জন থাকলেও মূল গায়ককে বলা হয় ক্বাসেদ। এটি মূলত গজলের একটি অংশ বা গীত। এটি গাওয়ার জন্য প্রথম দিকে কোনো যন্ত্রের ব্যবহার না থাকলেও পরে হারমোনিয়াম দিয়েও গাওয়া হতো। সাথে ঝুনঝুনির চলও ছিলো।

দিও ঢাকা শহরে এর সূত্রপাত নিয়ে মতভেদ রয়েছে তবুও শোনা যায় নবাবী আমল থেকেই এই রীতি পালন করে আসছিলো পুরান ঢাকাবাসী। ইতিহাস অনেক লম্বা। তবে যতটুক জানি নবাবরা নিজেরাই এই ক্বাসিদা রচনা করতেন। পুরান ঢাকার কোথাও উর্দু ভাষায় ক্বাসিদা গাওয়ার প্রচলন থাকলেও নবাবী আমলে চলতো ফারসি ক্বাসিদা। এটি তখন খুব জাঁকজমকভাবে পালন করা হতো। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলো কিছুটা। দিন গড়ানোর সাথে সাথে এটি বাংলাতেও অনুবাদ করে গাওয়া হতো। ধীরে ধীরে সাধারণের মাঝে ঢুকে যায় এই ক্বাসিদা। ক্বাসিদা গায়করা একে সওয়াবের কাজ মনে করতেন। তিন ভাগে ভাগ করে রমজানে ক্বাসিদা গাওয়া হতো। প্রথম দশ রোজায় আমাদি ক্বাসিদা, মাঝের দশ রোজায় ফাজায়েলি ক্বাসিদা ও শেষ দশ রোজায় বিদায়ী ক্বাসিদা। খোশ আমদেদ, আলবিদা, ঈদের সময় ঈদ মোবারক সহ অনেক ধরণের ক্বাসিদা গাওয়া হতো। পুরান ঢাকাবাসীরা খুশি হয়ে ঈদের আগে আগে ক্বাসিদা গায়কদের বকশিসও দিতেন।


ক্বাসিদা চলাকালীন চিত্র


পুরান ঢাকার বংশাল, নাজিরাবাজার, সাতরওজা রোড, চক বাজার, লালবাগ ও হোসনি দালানের আশেপাশে হয়তো এখনো ক্ষেত্র বিশেষে খুব কমই দেখা যায় ক্বাসিদা। কালের পরিক্রমায় এর রঙ বদলেছে। কখনো কখনো শুধুমাত্র ক্বাসিদা গায়ক একাই বেড়িয়ে পরতেন সেহরীতে রোজাদারদের ডেকে তোলার জন্য। আবার কখনো শুধু মুখেই ডাকা হতো, ‘রোজাদার! ওঠে পড়ুন! সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছে

তবে এখন আর খুব একটা শোনা যায় না। হয়তো ডিজিটাল যুগে মানুষ এখন এলার্ম সেট করেই উঠতে পারেন সেহরীতে। আবার অনেকেই এখন সেহরীর আগ পর্যন্ত ঘুমান না। এরকম অনেক কারণেই পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্য আজ বিলীনের পথে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ক্বাসিদার আর কোনো চলই থাকবে না

Comments

Popular Posts