সাদামাটা কোপায় বাজছে যুদ্ধের দামামা
ফুটবল ইতিহাসে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে, তার মধ্যে একুশের নাম নিঃসন্দেহে লিখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। সেই ইউরোর গ্রুপ অফ ডেথ (এফ গ্রুপ) থেকে নক-আউট পর্বের ফ্রান্স বনাম সুইজারল্যান্ড কিংবা স্পেন বনাম ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ- এমন কোনো ফুটবলপ্রেমী নেই যে অস্বীকার করতে পারবে ম্যাচগুলো উপভোগ করেনি। ইউরোর কন্ডিশন, দর্শক সবকিছু মিলিয়ে ইউরো ছিল এবারের জমজমাট আসর। করোনার মধ্যে তো বটেই! কিন্তু ইউরোপ পেরিয়ে লাটিন আমেরিকায়ও যে কোনো এক টুর্নামেন্ট চলছে সেদিকে যেনো অনেকেরই ভ্রূক্ষেপ ছিলো না। দর্শকহীন মাঠ, এদিকে করোনার কারণে কোপা আমেরিকা হওয়া না হওয়ার সম্ভাবনা যেনো সরল দোলকের পেন্ডুলামের মতই দুলছিলো। এদিকে ইউরো ভক্তদের অনেকেই দুয়ো দিতেও ভুলেননি কোপা আমেরিকাকে।
কিন্তু! কে জানতো কোপা আমেরিকাও যে অপেক্ষা করিয়েছে সমস্ত ফুটবল ভক্তকে, অপেক্ষায় রেখেছে আরও একটি মাহেন্দ্রক্ষণের। আরও একটি মহারণের। বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো ফুটবল বিশ্ব আজকে অপেক্ষমান সুপার ক্লাসিকোর। ১৪ টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের, ফুটবল প্রেমীদের। শেষবার ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলেছিলো ২০০৭ সালে যেখানে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে নিজেদের অষ্টম কোপা আমেরিকা জিতে নেয় ব্রাজিল। অন্যদিকে সুযোগ ছিলো রাইভাল ব্রাজিলকে হারিয়ে নিজেদের পনেরোতম কোপা আমেরিকা জিতে নেওয়ার। হয়নি।
এরপর একে একে আরও চার কোপা এসেছে। কখনো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সুপারক্লাসিকো ফাইনাল দেখেনি বিশ্ব। কেউ কি কখনো ভেবেছিলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এবারই চলে আসবে যেখানে ইউরো সমস্ত ফুটবল বিশ্বের মন জয় করে নিয়েছিলো? ভাবেনি। সৃষ্টিকর্তাও হয়তো খানিকটা তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক এবারের সাদামাটা কোপারই অপেক্ষা করছিলেন!
এর মাঝে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলেছে দুইবার। দুইবারই চিলির কাছে পরাজিত থাকতে হয়েছে। যে আর্জেন্টিনায় মেসি নামক এক ফুটবল বিস্ময় খেলে যাচ্ছেন, সে আর্জেন্টিনারই নাকি পরপর দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে একটি জয়ের অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাথে '১৪ এর বিশ্বকাপ ফাইনাল যেনো কাটা ঘায়ে নুন এর ছিটা খানিকটা এক করে দিয়ে গেলো। তবে ব্রাজিল গত কোপা আমেরিকায় পেরুকে হারিয়ে নিজেদের নবম শিরোপা ঘরে তোলে। কিন্তু এর মাঝে কখনোই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনালে মুখোমুখি হয়নি।
তবে এবার ফাইনালে ওঠাটা একদমই সহজ ছিলো না আর্জেন্টিনার জন্য। সেমি ফাইনালে কলম্বিয়ার শারীরিক শক্তিমত্তার সাথে যুদ্ধ করে আর্জেন্টিনাকে পার হতে হয়েছে টাইব্রেকার ধাক্কাও। লোকে বলে গয়কোচিয়া ভর করেছিলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ এর উপর। আবার লোকে এমির হাতকে 'ঈশ্বরের দুই হাত' বলতেও দ্বিধা করেননি। সে যাই হোক, মার্টিনেজ খানিকটা হুশিয়ারি দিয়েই দলকে ফাইনালে তুললেন। বলেকয়ে সেইভ করলেন তিন তিনটি পেনাল্টি। এরই মাঝে জানান দিলেন আর্জেন্টিনা তার নায়ক পেয়ে গেছে যাকে চোখ বন্ধ করে গোল পোস্টের নিচে ভরসা করা যায়।
১১ জুলাই, ২০২১
আরও একটিবারের জন্য পুরো বিশ্ব থমকে যাবে। বিশ্ব তো বটেই, সারা বাংলাদেশ যে তখন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। যে ছেলেটা সমস্ত সকাল বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোতে থাকে, সেও যে এক ঝটকায় ঘুম থেকে উঠে টিভি পর্দার সামনে বসে যাবে। এটা যে ক্লাসিকোর চেয়েও বেশি কিছু! গঙ্গা যমুনা যেমনটা এক হয়ে যায়; ধর্ম, বর্ণ ভুলে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ফুটবল ভক্তও যেনো এক হয়ে খেলা দেখবে, উপভোগ করবে প্রিয় দলের খেলা। এই একটি জিনিস সমস্ত জাতিকে এক করে দিতে পারে। পারে সম্মান ও শ্রদ্ধাকে আরও মজবুত করতে!
বাংলাদেশ সময় ভোর ৬টা। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে প্রিয় দলের খেলা দেখার মাঝে যে তৃপ্তি আছে এটা কখনোই ব্যাখ্যা করা যায় না, তার মধ্যে এটি ফাইনাল। আবার সুপার ক্লাসিকো! তবে এরই মাঝে পুরো ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষমান। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিবোর্ড যুদ্ধ অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়েছে ছাদে পতাকা লাগানোর হিড়িক। কোথাও কোথাও হতাহতের খবর যেনো নিত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশের ফুটবল প্রেমীদের জন্য যা কখনোই কাম্য নয়। ফুটবল কেবলই এক আনন্দের উৎস; সম্মানের জায়গা, বন্ধুত্বের জায়গা- ঠিক যেমন বন্ধুত্ব মেসি ও নেইমারের মাঝে দেখা যায়। নেইমারের কথায় যেনো ফুটে ওঠে সেই বন্ধুত্বেরই বাণী। কারণটাও খুব স্পষ্ট। লিওনেল মেসি কিংবা লিয়ান্দ্রো পারেদেস সবাই যে নেইমারের বন্ধু। কাটিয়েছেন অনেকটা বছর একই সাথে, একই ক্লাবে।
তবে, ফুটবলে উন্মাদনা থাকবেই। এ এক মহারণ। এ উন্মাদনা আছে বলেই ফুটবলপ্রেমীরা বেঁচে আছে। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে যেনো ফুটবলের চেয়ে কিছুই বড় হয়ে ওঠে না। সারা রাত জেগে অপেক্ষা কিংবা ভোরে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে খেলা উপভোগ করার চেয়ে উপভোগ্য আর কিছু নেই! প্রিয় দলের জয়ে উল্লাসে ফেটে পরা কিংবা হারের কষ্টের মাঝেই ফুটবল যেনো কোটি ভক্তের কাছে এক দেবতাস্বরূপ। সারাবছর ক্লাব ফুটবলে তো বটেই, জাতীয় দলের খেলায় যেনো উন্মাদনা বেড়ে দ্বিগুণ। এটা যে ক্ষণিকের জন্য আসে আবার এক লহমায় পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যায়!
তবে সবকিছু ছাপিয়ে চোখ থাকবে ম্যাচে। মাঠের নব্বই মিনিটে! যে ভালো খেলবে সেই জিতবে, শিরোপা উঁচিয়ে তুলবে। একটি শিরোপার জন্য মেসি নামক সেই জাদুকর কতটা মরিয়া হয়ে আছেন সেটা তার মুখে তো শোনা যায়ই, খেলা দেখেও না বুঝার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। খেলোয়াড়েরাও জীবন দিতে প্রস্তুত একটি শিরোপার জন্য। অন্যদিকে কোপার যোগ্য দল ফর্মে থাকা ব্রাজিলও যে মুখিয়ে আছে মেসিদের হারিয়ে শিরোপা নিশ্চিত করতে! কে হাসবে শেষ হাসি? আর্জেন্টিনার পনেরো নাকি ব্রাজিলের দশম?
১১ জুলাই, ২০২১- ইতিহাসটা না হয় লেখা হয়েই যাক!
Comments
Post a Comment