Procrastination




ধরুন আগামীকাল সকালে আপনার একটা সাবমিশন আছে। সাবমিশন ডেডলাইন আগামীকাল সকালেই। কিন্তু এদিকে আগের দিন ঠিক রাতে আপনার বন্ধু আপনাকে ফোন দিয়ে বললো- “দোস্ত, তোর এসাইনমেন্টটা একটু যদি দিতি!” কিংবাদোস্ত আমি না এসাইনমেন্টটা বুঝতেসি না। যদি একটু বুঝিয়ে দিতি!” এমন সিচুয়েশন হয়নি কারো এটা বলা টাফ। ভার্সিটি লাইফে এমন অনেক অনেক আবদার আসে সাবমিশনের ঠিক আগের রাতে। সে রাতে হয়তো আপনি অন্য কাজে ব্যস্ত। কিংবা কোনো কারণে আপনার বন্ধুকে সময় দিতে পারছেন না। এই অবস্থায় আপনার বন্ধুরও যেমন মন খারাপ, তেমন আপনারো মন খারাপ যে আপনি তাকে হেল্প করতে পারলেন না!


আমিও এমন প্রচুর নক পাই ফেসবুকে ঠিক শেষ মুহূর্তে। এই জিনিসটা আমি উপভোগ করি, এট দ্যা সেইম টাইম এই জিনিসটা বিরক্তিকর। কারণ, শেষ মুহূর্তে আপনি আপনার বন্ধুকে আপনার সাধ্যের পুরোপুরি দিতে পারবেন না। আপনি চান তাকে ভালোভাবে হেল্প করতে কিন্তু সময় স্বল্পতা আপনাকে কাজটা করতে দিবে না। সেক্ষেত্রে ধরেন ত্রিশ দিন সময় দেওয়া হয়েছে কাজটা শেষ করার। কেউ যদি এই ত্রিশ দিনের মাঝামাঝি বা শেষ মুহূর্তের আরও আগেই কিছু বুঝতে চায় এই ব্যাপারটা এঞ্জয়েবল। কারণ, আপনি তাকে হেল্প করে শান্তি পাবেন, পাশাপাশি সে বিষয়ে কিছুটা হলেও আপনি জ্ঞান আহরণ করবেন। সো, এটি আপনার জন্য উইন উইন সিচুয়েশন হতে পারে। তো গেলো বন্ধুদের কথা।


এখন নিজেদের দিকেই একটু তাকাই না! ডেডলাইনের ঠিক আগ মুহূর্তে আপনি তড়িঘড়ি করে আঁটসাঁট বেঁধে এসাইনমেন্ট করতে লেগে গেলেন! অথচ, গত এক মাস সময় থাকা সত্তেও নিজের মনকে বুঝাতে পারলেন না যে আপনার একটা কাজ বাকি আছে সেটা করতে হবে! আপনি ত্রিশ দিনই ব্যয় করে ফেললেন অন্যান্য কাজ করে। হোক সেটা সিনেমা দেখে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। এই হচ্ছে প্রোক্রাস্টিনেশন। যার সোজা বাংলা গড়িমসি করা।


এটা মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা প্রায়ই কাজ ফেলে রাখি। করবো করবো করে আর করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু কাজটা শেষ না করলেও হয় না। তাই সাবমিশনের ঠিক আগে আগে আমাদের টনক নড়ে। এটি আমাদের অনেক অনেক পিছিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিযোগীতার দুনিয়ায়। একটা কাজ ফেলে রেখে আমি যখন অন্য একটা আনপ্রোডাক্টিভ কাজ করতে থাকবো ইট কিলস টাইম। সময় বহিয়া যায় কিন্তু আমাদের আর সামনে আগানোটা হয়না। এটি যে শুধু আনপ্রোডাক্টিভ কাজ করে সময় নষ্ট এমনও না। কারণ, আজকের দুনিয়ায় প্রতিযোগিতাটা অনেক। সেক্ষেত্রে কেউ একজন বসে বসে সিনেমা দেখেই সব সময় শেষ করে ফেলেছে এটি বলাটা কঠিন। আমাদের সামনে অনেক কাজ। মাঝে মাঝে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি যে কোনটা রেখে কোনটা করবো এবং কোনটা আমাদের ‘প্রায়োরিটি’ হওয়া উচিত সেটি আমরা বুঝতে পারি না। সেক্ষেত্রে টপ প্রায়োরিটির কাজটি আমরা ফেলে রাখি। বাকি কাজগুলো করে ফেলি।


তাছাড়াও হতে পারে যে আমরা সময়ের মূল্য বুঝি না। Every single second you waste is gone foreverযখনই সময় পাই ফেসবুক, ইউটিউব তো আছেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও অনেকেই অনেক প্রোডাক্টিভ কাজ করছে এখন। কিন্তু প্রায়োরিটি বুঝতে না পারাটা নিজেদেরই ব্যার্থতা। আবার অনেক সময় এটিও হয় যে আমরা নিজেরাই সুশৃঙ্খল না। কখন কি করতে হবে তার কোনো ধারণাই নেই। নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না। নিজেদের বদ অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করতে পারি না। সেক্ষেত্রেও প্রোক্রাস্টিনেশন একটি বড় জায়গা জুড়ে কাজ করে। এখানে মনে রাখা দরকার, প্রোক্রাস্টিনেশন কোনোভাবেই ‘অলসতা’ নয়। অলসতা একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া যেখানে কাজ করতে আমাদের অনীহা প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রোক্রাস্টিনেশন আমাদের একটা টাস্ক ফেলে রেখে কিছুটা স্ট্রেস রিলিফের মত কাজ করে। একদিকে অবশ্যই পজিটিভ তবে অনেকাংশেই এটি নেগেটিভ। অনেক সময় স্ট্রেস বাড়িয়েও দেয়। কারণ এর ফলে নিজেকে অনেক দোষী মনে হয়। মনে হয় কি যেনো বাকি! নিজেকে হেল্পলেস মনে হওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক।

সাইকোলোজির প্রফেসর ড. টিম এর মতে, প্রোক্রাস্টিনেশন ইজ এন ইমোশন রেগুলেশন প্রোবলেম এবং এটি কোনো টাইম ম্যানেজমেন্ট প্রোবলেম না। আমাদের নিজেদের মুড অনেক সময়ই খারাপ থাকে। এই মুড রিপেয়ারের জন্যও আমরা প্রোক্রাস্টিনেট করি। আমাদের কাজ করতে ভালো লাগে না। ফেলে রাখি। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন। প্রোক্রাস্টিনেশন কি কোনোভাবে সোশ্যাল ইস্যু?

 

ওয়েল, এই প্রশ্নের উত্তর একদম সহজ। এটি অবশ্যই সামাজিক প্রক্রিয়া। মানুষের মন প্রতিনিয়ত সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তবে আমি এটিকে বলবো সাইকো-সোশ্যাল ইস্যু। শুধু সাইকোলোজি কিংবা সোশ্যাল ইস্যু দিয়ে এটিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং দুটিই প্রয়োজন! সবসময় এমন কাজগুলোই করতে চাই যেগুলো আমাদের পুরষ্কৃত করবে বা করতে ভালো লাগে। আমাদের মস্তিষ্ক তাড়না দেয় সে কাজগুলোই করতে। অর্থাৎ ভালো লাগা কাজগুলোই আমরা বেশি সময় ধরে করি। এতে মন ভালো থাকে। মানসিক প্রশান্তি আসে। কিন্তু যে কাজগুলো আমার অবশ্যই করতে হবে, একটি ডেডলাইন আছে সেটি পরেই থাকে। আর করা হয়ে ওঠে না।

 


এখন আসি এটি কিভাবে সাইকো-সোশ্যাল? আমাদের প্রত্যেকটা কাজ স্বভাবতই মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু মস্তিষ্কে তাড়না আসে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই। ধরেন, এংজাইটি আপনাকে জেঁকে বসলো। স্বভাবতই এটি ইন্ডিভিজুয়াল ফ্যাক্ট। কাজটি আপনি কাজ ফেলে রাখলেন পরে করবেন বলে। এটিও প্রোক্রাস্টিনেশনের একটি কারণ। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি উদ্বিগ্ন কেনো? এই ‘কেনো’র উত্তর খুঁজতে আমাকে যেতে হবে সমাজে। সমাজের মানুষে। যেতে হবে সামাজিক কর্মকান্ডে। এই উদ্বিগ্ন হওয়ার পেছনের কারণগুলোর মধ্যেই সামাজিক কর্মকান্ড জড়িত যেটি আপনাকে মুহূর্তেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আপনার বন্ধুর মোবাইল আছে আপনার নাই। আপনার সমাজে বিশৃঙ্খলা, আপনি চিন্তিত। এরকম বহু কাজের দ্বারাই আমাদের ব্যক্তিগত জীবন প্রভাবিত হয়।

 

সমাজের স্তরভেদে আবার এর ধরণও পালটে যায়। যে ছেলেটার আর্থিক অসচ্ছলতা আছে তার চাহিদাও সীমিত। সে হিসাবে তার কাজ করার পরিধিটুকুও সীমিত। সে অন্য কাজে সময় ব্যয় একটু কমই করবে। তার নির্দিষ্ট একটি কাজ করার তাড়না আছে। কিন্তু যে ছেলেটার আর্থিক অবস্থা একটু ভালো, তার বাসায় কম্পিউটার, ইন্টারনেট থেকে শুরু করে সবই থাকতে পারে। তার বন্ধু আছে, সে আড্ডাও দিতে পারে ইচ্ছেমত। সেক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয় কাজটুকু ফেলে রাখার সম্ভাবনা প্রবল। পক্ষান্তরে, যার সুবিধা কম, সে অনেকাংশেই সময়ের কাজ সময়ে শেষ করে ফেলতে পারে। কিন্তু!

 

কিন্তু শুধু এতটুকু দিয়েই আমি সমাজে প্রক্রাস্টিনেটের একটা আইডিয়া পাবো না। আমাকে অন্যান্য ফ্যাক্টরও দেখতে হতে পারে। যেমন মুড খারাপ কিংবা এংজাইটি, ডিপ্রেশন, মোটিভেশনের অভাব এসব কিছুই আমি কারণ হিসাবে দেখাতে পারি। এতে মনস্তাত্ত্বিক দিক যেমন বিদ্যমান, তেমনি সমাজের কাজের দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে।

 

এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সেলফ মোটিভেশন অনেকাংশেই কার্যকর। তাছাড়া নিজেকে হতে হবে ‘গোল ওরিয়েন্টেড’। নিজের ফোকাস ঠিক রেখতে হবে। নিজের জীবনকে অর্গানাইজড ভাবে সাজাতে হবে। তাহলে প্রোক্রাস্টিনেশনের প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। তবে এখানে অনেকেরই দ্বিমত আছে। অনেকের কাছেই প্রক্রাস্টিনেশনটা ভালো দিক। তারা মনে করেন, প্রক্রাস্টিনেশনের কারণে কম সময়ে প্রেশারে ভালো কাজ করা যায় এবং নতুন নতুন চিন্তা মাথায় আসে। উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারা ‘Out of the box’ চিন্তা করতে পারেন। তারা হঠাৎ করেই নতুন নতুন জিনিস নিয়ে ভাবতে পারেন। এটি ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা। তবে সর্ব সাকুল্যে প্রোক্রাস্টিনেশন একটি সাইকো সোশ্যাল ইস্যু হিসেবেই আমার কাছে পরিগণিত হবে। কারণ শুধু একটি দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা কঠিন।

Comments

Popular Posts