প্রিয় মেসি
কিন্তু যে চলে যায় আর যাকে রেখে চলে যায় এই দুইয়ের মনের মধ্যেই বইতে থাকে বিষাদের ফোয়ারা। যার কাছে যায়, সে কি বিষন্ন থাকে? একদমই না। বিচ্ছেদের কষ্ট অনেক বড়। শত হলেও মানুষের মধ্যে এক মায়া কাজ তো করে! মানুষের জীবণ চিরস্থায়ী নয়। নিছকই এক ঘোর। ঘোর কাটলে সে জীবণ আর জীবণ থাকে না। এই দুনিয়াও যেনো একটা ঘোর, স্বপ্নের রাজ্য। এখানে কিছুই চিরস্থায়ী থাকে না। আসা যাওয়ার খেলা চলে মৃত্যুর আগ অবধি। এমনকি মৃত্যুর পরও।
লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। যিনি এসেছিলেন খালি হাতে, এক স্বপ্নের রাজ্যে। বিদায়বেলায়ও খালি হাতেই চলে গেলেন। এর মাঝে যা হয়েছে সবকিছুই তুচ্ছ। মানুষটাই তো নেই। এত এত কিছু শোভা পাবে সেই বার্সেলোনার মিউজিয়ামে। সাজানো থাকবে। নতুনেরা আসবে, দেখবে। মেসি তো চলেই গেলেন! কি পেলাম কি পেলাম না তার চেয়ে বড় কথা মানুষটাই তো আর ক্যাম্প ন্যু প্রাঙ্গণে পা রাখবেন না! যে ভালোবাসা নিয়ে গেলেন মেসি, সে ভালোবাসা দিয়েই বা কি আসবে যাবে! সেই ন্যু ক্যাম্প প্রাঙ্গণ তো আর মেসি কলরবে ভরে উঠবে না। হ্যাঁ উঠবে, যেদিন মেসি তার নতুন ঠিকানা সঙ্গী করে এই বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলতে আসবেন সেদিন উঠবে। মেসি- ভিস্কা এল বার্সা, ভিস্কা কাতালুনিয়া। নিরানব্বই হাজার দর্শকের সামনে বলা মেসির এই কথাগুলো আমার কানে লেগে আছে, থাকবে। ভিস্কা এল কাতালুনিয়া যার মুখে মানায় সে কিভাবে এই কাতালানদের বিপক্ষে মাঠে নামবে? সে উত্তর হয়তো আমি খুঁজে বেড়াবো মৃত্যুর আগ অবধি।
যে মেসি মেসি হয়ে উঠতেন না বার্সেলোনা নামক ক্লাবটা না থাকলে সেই মেসি যেমন তার জীবনে পেয়েছেন অনেক কিছু, দিয়েছেনও দু'হাত ভরে। যে মেসি এসেছিলেন এক ন্যাপকিনে সাইন করে, ভালোবাসা দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন সমস্ত কাতালুনিয়াকে, সে মেসি চলে গেলেন সবকিছু পেছনে ফেলে। বিদায় বেলায়ও সেই টিস্যুতে বারবার চোখ মোছা কারো চোখ এড়ায়নি। লোকে বলে মেসি নাকি বার্সেলোনার প্রতি লয়্যাল না। আচ্ছা, যারা বলে তারা কি তার মায়ের ঋণ শোধ করতে পেরেছে? পারেনি। পারবেও না কখনো। মেসি বার্সার কাছে চির ঋণী। যে বার্সা তাকে হরমোনাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে মেসি করে তুলেছে সেই বার্সার প্রতিই মেসি লয়্যাল থাকবেন না? হাহ! নিছকই এক ঘোর! এই ঘোর কেটে যাক। মেসি যা, তার থেকেও বেশি কিছু উপহার দিয়ে চলে যাচ্ছেন। ওই যে বলেছিলাম না, এসকল কিছুই তুচ্ছ আমার কাছে। সে কাতালানবাসীর কাছে এসকল কিছুই না। তাদের যে শুধু মেসিকেই চাই। যে মেসিটা হাসবেন, খেলবেন। খেলাবেন। গোল করে দু হাত উঁচিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাবেন। এই মেসিটাই তো নেই!
আমার মনে পড়ে, স্যার ক্রুইফ যখন মারা যান, তখন তিনি ক্লাবের কেউ ছিলেন না। ক্লাবের গদিতে ছিলো কিছু লম্পট, বদমায়েশ যারা কিনা ক্রুইফকে তার ঘরছাড়া করেছিলো। ক্রুইফিস্তারা প্রচুর ঘাড়ত্যারা। প্রচুর। স্যার ক্রুইফ কথা দিয়েছিলেন যে তিনি আর ক্যাম্প ন্যু প্রাঙ্গণে পা রাখবেন না। মৃত্যুর আগে এক্টিবারের জন্যও রাখেননি। কি কষ্ট নিয়ে মরতে হয়েছিলো স্যার ক্রুইফকে, যে ক্রুইফ এই বার্সেলোনাকে, সমস্ত কাতালানবাসীকে এনে দিয়েছিলেন পুনর্জন্ম তাকেই মরতে হলো ক্লাবের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে? কথার দামই বেশি হয়ে গেলো? আমি জানি না, পেপ গার্দিওলা বেঁচে থাকতে এফ সি বার্সেলোনায় ফিরে আসবেন কিনা। কথার দামের কাছে কোটি ভক্তের মিনতিও যেনো খুবই তুচ্ছ এদের! এ কোন খেলা আমার জানা নেই! তবে লিওনেল মেসির ক্ষেত্রে অন্তত এমনটা হয়নি তা ভেবেই আমি শান্তি পাচ্ছি। পাবো। যাই হোক, এটা অন্তত স্পষ্ট, আসা যাওয়ার খেলায় অনেক কিছুই হয়ে যায়, পেছন ফেরে আর তাকানো হয় না! আকাশটা প্রতি নিয়ত তার রঙ পাল্টাতে থাকবেই।
কি হলো কি হলো না, কিভাবে হলো তার চেয়েও বড় কথা হলো- হয়ে গিয়েছে। পুরাতন ঠিকানাকে বিদায় বলে দিতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নতুন ঠিকানাকে আপন করে নিতে হয়। মেসি নিবেনও। কি হবে নতুন ঠিকানা, সেখানে কেমন করবেন, কেমন থাকবেন তার চেয়েও বড় কথা তিনি আর বার্সেলোনা শহরে নেই। শেষটা সুন্দর হলেও হতে পারতো। পারতো আরও বর্ণীল হতে। কিন্তু বিধাতা তার ভাগ্যে রাখেন নি। এরকম অনেকের ভাগ্যেই বিধাতা সব কিছু রাখেন না। যে মেসি কিনা নিজ ইচ্ছায় চলে যেতে পারতেন গত বছরই, সেই মেসি চুক্তির গ্যাড়াকলে পরে থেকে গেলেন। খেললেন। খেলালেন। তবে এবার যখন মেসি চেয়েছিলেন প্রাণের শহরটায় থেকে যেতে, পারেন নি। ভাগ্যে ছিলো না। ভাগ্যের লিখন খন্ডানো যায় না। যে বার্তমেউ এর জন্য মেসি বার্সেলোনাকে বিদায় বলতে চেয়েছিলেন, সেই বার্তোমেউ যদি আজ থাকতেন তাহলে মেসি হয়তো বার্সাতেই থেকে যেতেন। হ্যাঁ, ভুল দেখেননি। বার্তোমেউ থাকলে হয়তো থেকে যেতেন আজকে মেসি। যাই হোক, থাকেননি এটাই বড় কথা।
অনেক কিছুই বলা যায় তবে যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে। মেসি চলে গেছেন তার নতুন ঠিকানায়। তবে টিটো ভিলানোভা কি আজকে দেখছেন ওপাড় থেকে? সব প্রমিজ যে চাইলেও রাখা যায় না টিটো! ভিলানোভা আজ কাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন? মেসি? বার্সেলোনা? বার্তোমেউ? লাপোর্তা? নাকি তেবাস? অনেক জানতে ইচ্ছে করে। সেই সাত বছর আগে যে মেসিকে রেখে দিয়েছিলেন, প্রমিজ করিয়েছিলেন সেই ভিলানোভা, সব কিছু এক ঝটকায় শেষ? নাহ! অনেক যদি-কিন্তুর জন্ম দিয়ে মেসি চলে গেলেন সব পেছনে ফেলে। হয়তো ফিরবেন, হয়তো ফিরবেন না।
তবে, আমি দেখেছি, ক্যাম্প ন্যু প্রাঙ্গণে কিভাবে কাঁদছে কোটি ভক্ত। কিভাবে আকুতি মিনতি করছে কেবলই এক ছবির দিকে তাকিয়ে। যে ছবি কথা বলে না, যে ছবি ভাষা বুঝে না, সে ছবির দিকে তাকিয়ে কত মিনতি মানুষের! কিন্তু, কিন্তু করোনা মহামারী কি একদমই নির্মম? শেষবার যে মানুষগুলো ক্যাম্প ন্যু গেইটে ভিড় জমিয়েছিলো তাদের অনেকেই আজ নেই। দেখছেন না। যারা আছেন সবাই যেতে পারছেন না। যে করোনা কোটি ভক্তকে না ফেরার দেশে ঠেলে দিলো সে করোনা এতই নির্মম যে মেসিকেও শেষ পর্যন্ত ক্লাব ছাড়া করে দিলো! এতই নির্মম যে মানুষগুলো আজ বিদায় জানাতে পারছে না তার রাজাকে! আমি দেখেছি, লিওর জার্সি হাতে ছেলেটা কাঁদছে, কাঁদছে তার রাজার দিকে তাকিয়ে। বারবার কেঁদে বলছে- ‘লিও আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ লিও’। এই কান্নায় কারো প্রতি ক্ষোভ নেই, আছে শুধু হারিয়ে খুঁজে ফেরার ক্ষত। যে গ্যাড়াকলে পড়ে মেসি থেকে গেলেন, সে গ্যাড়াকলে পড়েই কিনা শেষ পর্যন্ত মেসিকে ছাড়তে হলো তার প্রাণের শহর! কি নির্মম। যে ছেলেটা জানে না যে একটু পরই আমাকে চলে যেতে হবে, সে ছেলে কিভাবে এতদিনের পুরোনো ঠিকানাকে পেছনে ফেলে চলে যাবে নতুন ঠিকানায় আমার জানা নেই। হাহ! সেই কাতালুনিয়াবাসী কিংবা আমাদের কথা তো বাদই দিলাম। তবে, আমি বিশ্বাস করি, আমি বিশ্বাস করি আকাশটা আরও সুন্দর হবে, নির্মল হয়ে ধরা দিবে।
বেশি কিছু লিখতে চাই না। স্মৃতি কাতরাতে চাই না। চাই না আর দশটা মানুষও কষ্ট পাক। যাই হোক, বলেছিলাম যে, বিচ্ছেদের পর যার কাছে যায় সে কখনো কষ্ট পায় না। সে স্বাদরে বরণ করে নেয় তার প্রিয়কে। আইফেল টাওয়ার হয়তো সাজছে ফুটবলের বরপুত্রকে বরণ করে নিতে। সেখানে পার্টি হবে, অনেক অনেক মাস্তি হবে। তবে............
ভালো থাকবেন মেসি। অনেক ভালো থাকবেন।
Comments
Post a Comment